জনপ্রিয় পোস্টসমূহ দেখুন

মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৪

বাংলাদেশে হাবশী শাসক



আমাদের এই দেশ একসময় সুদূর আফ্রিকা থেকে আগত হাবশীদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে হাবশী কারা? 'হাবশা' বলতে মূলত ইথিওপিয়া (আবিসিনিয়া) ও ইরিত্রিয়া দেশ দুইটিকে বোঝায় এবং এই হাবশা অঞ্চলের অধিবাসীদেরকেই আমরা চিনি হাবশি নামে। জলদস্যুরা আবিসিনিয়া সীমান্তে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য হাবশি পুরুষকে ধরে এনে দাস হিসেবে বিক্রি করতো বিভিন্ন অঞ্চলে। এই হতভাগ্য হাবশিরা বিভিন্ন স্থানে দাস হিসেবে কাজ করতো এবং তারা বিভিন্ন মুসলিম রাজাদের সেনাবাহিনীতে সৈনিক (স্লেভ সোলজার) হিসেবেও যোগদান করতেন। এভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে হাবশি কৃতদাসেরা নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে স্বীয় পারদর্শিতা বলে সেনাপতির মতো উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতেন এবং ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারতেন। এভাবে হাবশিরা সৈনিক ও প্রশাসক হিসেবে নিজেদেরকে একটি 'এলিট ক্লাস' হিসেবে পরিচিত করে তোলেন এবং কঠোর পরিশ্রমের জন্য খ্যাতিমান ছিলেন। এই হাবশিরাই হয়ে উঠেছিলো বাংলার ইতিহাসের অংশ।

১৪৩৩ সালে গণেশ পরিবারের (House of Raja Ganesha) সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শামসউদ্দিন আহমাদ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি বাবার ন্যায় যোগ্যতাবান সুশাসক ছিলেন এবং তিনি বাবার মতোই হিন্দু-বৌদ্ধদের প্রতি সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করেছিলেন। তিনি মাত্র তিন বছর শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। ১৪৩৬ সালে তিনি তাঁর দুই বিপথগামী শক্তিশালী দাস কর্তৃক শহীদ হন। তাঁর দুই ঘাতককে সাম্রাজ্যের আমির-ওমরাহগণ কর্তৃক হত্যা করা হয় এবং ইলিয়াস শাহী রাজবংশ পুনরায় ১৪৩৬ সালে বাংলার ক্ষমতায় আসে। ইলিয়াস শাহী বংশধর নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ সিংহাসনে বসেন। 

রাজা গণেশ এবং তার পরিবারের রাজত্বকালে ইলিয়াস শাহী রাজপরিবারের সদস্যগণ রাজধানী থেকে দূরে দক্ষিণ বঙ্গে নির্বাসিত ছিলেন। ১৪৩৬ সালে ইলিয়াস শাহী বংশধর নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ ক্ষমতায় বসেন। এরপর ক্ষমতায় বসেন তাঁর পুত্র রুকনুদ্দিন বারবাক শাহ্। তিনি অত্যন্ত প্রতাপশালী ও সুশাসক ছিলেন। কিন্তু বারবাক শাহ্ একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি ইলিয়াস শাহী বংশের ক্ষমতা কাঠামো শক্তিশালী করার জন্য স্থানীয় পাইকদের উপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে আবিসিনিয়া থেকে ৮০০০ দক্ষ হাবশি দাসকে বাংলায় নিয়ে আসেন। কারণ, তিনি জানেন পূর্বে তাঁর পূর্ব-পুরুষরা স্থানীয় অভিজাত হিন্দুদের সুবিধা দিয়ে চরম ভুল করে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। তাই তিনি ক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য হাবশিদের নিয়ে এসে পরম যত্নে তাদের নিয়ে নিজের একটি এলিট বাহিনী তৈরি করে ফেলে।

এভাবে ধীরে ধীরে হাবশিদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে এবং জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন প্রশাসনের প্রতিটি স্তর চলে গেছে হাবশিদের নিয়ন্ত্রণে। জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ্ অবস্থা বেগতিক বুঝে হাবশিদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করতে লাগলেন। ১৪৮৭ সালের এক সন্ধ্যায় প্রাসাদ রক্ষীদের অধিনায়ক শাহজাদা বারবক নামক এক খোজার নেতৃত্বে হাবশিরা বিদ্রোহ করে ও সুলতানকে হত্যা করে। এভাবেই চিরতরে বাংলার ক্ষমতা থেকে উৎখাত ঘটে ইলিয়াস শাহী বংশের। সিংহাসনে বসে শাহজাদা বারবাক নামের সেই হাবশি খোজা। সে 'সুলতান শাহজাদা' হিসেবে নিজেকে আখ্যায়িত করে সিংহাসন দখল করে। কিন্তু সুলতান শাহজাদা বারবাক খোজা হওয়ায় অভিজাতদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং কয়েকমাস রাজত্ব করার পর ১৪৮৭ সালেই মালিক আন্দিল নামের এক সেনাপতি তাঁকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন ও সাইফ-উদ-দীন ফিরোজ শাহ নামধারণ করে সিংহাসনে বসেন। তিনিই হাবশি সুলতানদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা যোগ্য ছিলেন। তিনি রাজধানী গৌড়ে 'ফিরোজ মিনার' নির্মাণ করেন। তিনিও ঘাতক কর্তৃক নিহত হন এবং এরপর হাবাশ খান নামক এক শক্তিশালী হাবশি অভিজাতের সমর্থনে ক্ষমতায় বসেন কুতুবউদ্দিন মাহমুদ শাহ্।

হাবশি শাসনের পুরোটা সময় জুড়েই এভাবে এক হাবশি কর্তৃক আরেক হাবশিকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল, প্রাসাদ চক্রান্ত চলতে থাকায় চরম অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসেন আরেক হাবশি অভিজাত শামসউদ্দিন মোজাফফর শাহ্। এভাবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বাংলার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়লে হাবশি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে এবং হাবশি শাসন বন্ধের দাবিতে ১৪৯৩ সালে ক্রুব্ধ জনতা, সৈনিক ও সাম্রাজ্যের অভিজাত সম্প্রদায় রাজপ্রাসাদ ঘেরাও করেন। এই বিদ্রোহের পেছন থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন শামসউদ্দিন মোজাফফর শাহেরই প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ হোসেন। বিদ্রোহীরা শেষ হাবশি সুলতান শামসউদ্দিন মোজাফফর শাহ্কে হত্যা করেন এবং সফল বিদ্রোহের মূলনায়ক সৈয়দ হোসেনকে সিংহাসনে বসান।

সৈয়দ হোসেন "আলাউদ্দিন হোসেন শাহ" নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন ও হোসেন শাহী বংশের শাসনের সূচনা করেন। ১৪৯৪ সালে দীর্ঘ ছয় বছরের (১৪৮৭-১৪৯৩) হাবশি দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলার ক্ষমতায় বসেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্। তিনি ৬ বছরের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ভেঙে পড়া সাম্রাজ্যকে আবার গৌরবময় অতীতে ফিরিয়ে আনায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। তিনি হাবশিদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেন এবং প্রশাসনকে হাবশি প্রভাবমুক্ত করে স্থানীয় মানুষ ও আরব, তুর্কি পাঠান বংশোদ্ভুত ব্যক্তিদের প্রশাসনিক পদে নিযুক্তি দেন। এভাবে হাবশি দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলার গৌরব পুন:প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের অবদান সত্যিই অনন্য।

তথ্য:
১. আমার সোনার বাংলাদেশ- মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
২. এই আমাদের বাংলাদেশ- সুব্রত বড়ুয়া
৩. মধ্যযুগে বাংলা- খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত
#মুসলমানদের_স্বর্ণকণিকা #বাংলার_ইতিহাস #history #muslimhistory

সৌজন্যেঃ- বাইশারী আল-হেরা তাহফীজুল কুরআন আবেদীয়া মাদরাসা ও এতিমখানা ৷ যোগাযোগঃ-01810111919/01575406346

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট গুলো দেখুন, আর মন দিয়ে পড়ুন৷ আমার জানা মতে ক্ষতি হবেনা আপনার৷ ইশা-আল্ল-হ৷

বাংলাদেশে হাবশী শাসক

আমাদের এই দেশ একসময় সুদূর আফ্রিকা থেকে আগত হাবশীদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে হাবশী কারা? 'হাবশা' বলতে মূলত ইথ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ দেখুন