জনপ্রিয় পোস্টসমূহ দেখুন

শুক্রবার, ২৪ মে, ২০১৯

মহিমান্বিত রজনী শবে-ক্বদর ও ই’তিকাফঃ

মহিমান্বিত রজনী শবে-ক্বদর ও ই’তিকাফঃ ফাযায়েল ও মাসায়েল
*হাফেজ আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী দাঃ বাঃ* 


শবে ক্বদরের তত্ত্ব ও মাহাত্ম্য

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইব্নে আবি হাতেম (রাহ্.) তাফ্সীরের ইমাম হযরত মুজাহিদ (রাহ্.) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক দিন সাহাবায়ে কিরামের বৈঠকে বনী ইসরাঈলের এক মুজাহিদের কথা উল্লেখ করেন। যিনি এক হাজার মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহ্র রাস্তায় লিপ্ত ছিলেন। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কিরাম আফসোস প্রকাশ করেন যে, এক হাজার মাস অর্থাৎ তিরাশি বছর চার মাস তো এ যুগে অনেকে জীবনও পায় না। তাই হযরত মূসা (আ.)এর উম্মতের মত এত অধিক সাওয়াব লাভের অবকাশও উম্মতে মুহাম্মদীর নেই। সাহাবায়ে কিরামের এ আফ্সোস অনুশোচনাকালে হযরত জিব্রাঈল (আ.) আল্লাহ্র পক্ষ হতে কুরআন মাজীদের সূরা ‘ক্বদর’ নিয়ে হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আগমন করেন। সে সূরায়ে ক্বদরে বলা হয় যে, লাইলাতুল ক্বদর এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। অর্থাৎ শবে ক্বদরের ইবাদত এক হাজার মাসের অবিশ্রান্ত ইবাদতের চেয়েও অধিক সাওয়াব রাখে। (বাইহাক্বী শরীফ, মাআরিফুল কুরআন)।

এ হাদীস হতে বুঝা যায় যে, শবে ক্বদরের মত এত নিয়ামতের রাত আল্লাহ্ তাআলা অন্য কোন উম্মতকে দান করেননি। তাই শবে ক্বদরের এ অফুরন্ত বরকতময় রাতের অনুসন্ধান প্রত্যেক মুসলমানদের কর্তব্য।

শাব্দিক ব্যাখ্যাঃ ক্বদরের এক অর্থ হল, মর্যাদা ও মাহাত্ম্য। অফুরন্ত মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের প্রেক্ষিতে এ রাতকে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ বলা হয়। বিখ্যাত আলেম হযরত আবুবকর উররাক (রাহ্.) বলেন, এ রাতের ইবাদত-বন্দেগীর কল্যাণে একজন নগণ্য মানুষও আল্লাহ্র দৃষ্টিতে মর্যাদা সম্পন্ন হতে পারে।

ক্বদরের দ্বিতীয় অর্থ হল, তাক্বদীর ও হুকুম। সৃষ্টির প্রথম দিনে প্রত্যেক মানুষের ভাগ্যে যা কিছু লেখা থাকে, এক রমযান হতে অপর রমযান পর্যন্ত তার সরবরাহের হুকুম ও দায়-দায়িত্ব আল্লাহ্ তাআলা এ রাতেই ফেরেশ্তাদের দিয়ে দেন। হযরত ইব্নে আব্বাস (রাযি.)এর এক বর্ণনা মতে শা’বান মাসের ১৫তম রজনী অর্থাৎ শবে বরাতে আল্লাহ্ এক বছরের জন্য বান্দার রুযী-রিয্ক, হায়াত-মউত ও অন্যান্য তাক্বদীরী ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর শবে ক্বদরে সেসব সিদ্ধান্তের প্রয়োগ এবং রুযী-রিয্ক প্রভৃতি সরবরাহের দায়িত্ব আল্লাহ্ ফেরেশ্তাদের দিয়ে থাকেন। (কুরতুবী)।

শবে ক্বদর নির্ধারণ

ক্বদরের রাত নির্ধারণের ব্যাপারে উলামা ও ইমামগণের বহু উক্তি রয়েছে। তন্মধ্যে কতিপয় উক্তি নিম্নে বর্ণিত হল-
(এক) ইমাম আবু হানিফা (রাহ্.)এর মতে শবে ক্বদর রমযানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বছরের যে কোন রাতে তা হতে পারে। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে হযরত ইব্নে আব্বাস ও ইব্নে মাসঊদ (রাযি.) হতেও এ ধরনের উক্তি বর্ণিত আছে। আরিফে রব্বানী হযরত মুহিউদ্দীন ইব্নে আরবী (রাহ্.) বলেন, আমি শবে ক্বদরকে দুই বার রমযান শরীফে এবং দুই বার শা’বান মাসে প্রত্যক্ষ করেছি।

তাই আমার বিশ্বাস শবে ক্বদর বছরের বিভিন্ন মাসে ঘুরতে থাকে। (দুই) অধিকাংশ ইমাম বিশেষতঃ হানাফী মাযহাবের ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (রাহ্.)এর মতে এবং ইমাম আবু হানিফা (রাহ্.)এর অপর এক উক্তি মতে শবে ক্বদর রমযান মাসে হতে পারে। (তিন) ইমাম মালেক ও ইমাম আহ্মদ (রাহ্.)এর মতে রমযানের শেষ দশকে হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। (চার) প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত আল্লামা ইব্নে খুযাইমাহ্ (রাহ্.) এবং আরো অনেক আলেমের মতে রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত অর্থাৎ ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯তম রজনীতে হওয়ার সম্ভাবনা অধিক।

(পাঁচ) শাফেঈ মাযহাবের ইমামগণের মতে বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে ২১ তারিখে হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। (ছয়) তবে অধিকাংশ আলেমের মতে ২৭ তারিখে হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা (রাহ্.)এরও একটি উক্তি পাওয়া যায়। আল্লামা আইনী (রাহ্.) উমদাতুল ক্বারী নামক গ্রন্থে লিখেন, ২৭ তারিখের রাতে শবে ক্বদর হওয়ার ব্যাপারে অধিকাংশ আলেমের উক্তি ঐক্যমত পাওয়া যায়। মোটকথা, শবে ক্বদর নির্ধারণে বিভিন্ন হাদীস থাকায় ইমামগণের বিভিন্ন উক্তি পরিলক্ষিত হয়। তবে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস মতে রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশী দেখা যায়।

বুখারী শরীফের হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, রমযানের শেষ দশকে শবে ক্বদরের অনুসন্ধান কর। মুসলিম শরীফের হাদীসে আছে, শবে ক্বদরকে রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে অনুসন্ধান কর। বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে ২৭ তারিখের সম্ভাবনা বেশী। তদপ্রতি কতিপয় সাহাবীরও সমর্থন রয়েছে। এমন কি বুযুর্গ সাহাবী হযরত উবাই ইব্নে কা’ব (রাযি.) এ ব্যাপারে নিশ্চিত। সারকথা, শবে ক্বদরের মহান ফযীলতের রাতকে যথাসম্ভব গোটা রমযানে তালাশ করা উচিত। অর্থাৎ রমযানের প্রত্যেকটি রাত যদি যথাযথ ইবাদত ও তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে অতিবাহিত করা হয়, তবে শবে ক্বদর অবশ্যই নসীব হবে বলে দৃঢ় আশা করা যায়। আর তা সম্ভব না হলে অন্ততঃ শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে জাগ্রত থেকে যিক্র-আযকার, তাসবীহ্-তাহলীল, তিলাওয়াতে কুরআন, নফল নামায প্রভৃতির মাধ্যমে শবে ক্বদরের ফযীলত হাসিল করা যেতে পারে। আর কিছু না হলে অবশ্যই ঈশা ও ফজরের নামায জামাআতের সাথে আদায় করে নিলে শবে ক্বদর নসীব না হওয়ার আশঙ্কা নেই বল্লেই চলে। কারণ, হাদীস মতে ঈশা ও ফজরের নামায জামাআতের সাথে আদায় করা সম্পূর্ণ রাত ইবাদত করার সমতুল্য। আর যদি বেজোড় রাতগুলো পূর্ণভাবে ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত করার সুযোগ না হয়, তবে অন্ততঃ ২৭ তারিখের রাতের গুরুত্ব দেওয়া এবং পুরো রাত ইবাদত-বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকা দরকার। (ক্বাযী খান, মাআরিফুস্ সুনান)।

গোপনীয়তার রহস্য

শবে ক্বদরের রাতকে গোপন রাখার মধ্যে রয়েছে আল্লাহ্র বিরাট হিকমত ও রহস্য। প্রত্যেক মূল্যবান বস্তু হাসিল করা যেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তেমনি আল্লাহ্র উদ্দেশ্য হল এ মহামূল্যবান রাতের অনুসন্ধানে বান্দা সাধনা করুক। এক রাতের জন্য ত্রিশটি রাত জাগ্রত থাকুক।
আমরা দুনিয়ার কত তুচ্ছ জিনিসের জন্য কত রাতের নিদ্রা হারাম করে দিই। কিন্তু এক হাজার মাসেরও অধিক মর্যাদা সম্পন্ন একটি রাতের জন্য কিছু কষ্ট স্বীকার করতে পারি না?

শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কিরাম শবে ক্বদরের গোপনীয়তার এ রহস্যও ব্যক্ত করেন যে, শবে ক্বদর যদি নির্দিষ্ট রাতে অনুষ্ঠিত হত এবং তা মানুষের জানা থাকত, তবে অনেক অলস ও গাফেল হতভাগ্য ব্যক্তি এমন একটি মহান রাতের মর্যাদা না দিয়ে আল্লাহ্র গযবে পতিত হত। হাদীস শরীফে আছে, এক দিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে গিয়ে জনৈক সাহাবীকে নিদ্রাবস্থায় দেখেন। তিনি নিজে কিছু না বলে হযরত আলী (রাযি.)কে বলেন, লোকটিকে উঠিয়ে দাও। পরে সাহাবায়ে কিরাম হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! প্রত্যেক নেক কাজে আপনাকে অগ্রবর্তী দেখি কিন্তু এখানে আপনি নিজে না বলে আলী (রাযি.)কে হুকুম দিলেন কেন? উত্তরে বলেন, আমি যদি তাকে ডাকি এবং এ সত্ত্বেও সে না উঠে তবে বড় অপরাধী হত।

তেমনি শবে ক্বদর গোপন থাকাও এক বড় নিয়ামত। শবে ক্বদর নির্দিষ্ট থাকলে কেউ জেনেশুনে যদি এর যথাযথ গুরুত্ব না দেয়, তবে আল্লাহ্র গযব হতে বাঁচার কোন উপায় থাকবে না।

শবে ক্বদরের ফযীলত

এর প্রধান ফযীলত সম্পর্কে কুরআন মাজীদে সূরাতুল ক্বদর-এ বর্ণিত আছে, এক হাজার মাস বা তিরাশি বছর চার মাস ইবাদতের চেয়ে সে এক রাতের ইবাদতের সাওয়াব অনেক বেশী। কত বেশী তার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। দুই গুণ বা তিন গুণ বা দশ গুণ বা একশ’ গুণও হতে পারে। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি শবে ক্বদরে দন্ডায়মান থাকে অর্থাৎ ইবাদত করে দ্বীনের হুকুম মনে করে এবং সাওয়াবের নিয়্যাতে, তবে তার অতীত গুনাহ্ মাফ হয়ে যায়। (বাইহাক্বী শরীফ)।

অপর হাদীসে আছে, ক্বদরের রাত্রে হযরত জিব্রাঈল (আ.) একদল ফেরেশ্তা নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং প্রত্যেক সেই বান্দার জন্য দোয়া করেন যাকে নামাযে দন্ডায়মান বা অন্য কোন ইবাদতে নিয়োজিত দেখে। (মাআরিফুল হাদীস)। অন্য এক হাদীসে আছে, (রমযানের) এ মাসটি তোমাদের নিকট আসল। এ মাসে এমন এক রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের বরকত থেকে বঞ্চিত, সে সকল মঙ্গল হতে বঞ্চিত হল। (ইব্নে মাজাহ্)। অর্থাৎ এ রাতে যার ইবাদতের কোন অংশ নেই তার মত হতভাগ্যও আর কেউ নেই। শবে ক্বদরের মহত্ব এ একটি বিষয় হতেও পরিস্কার হয় যে, এ রাতেই কুরআন মাজীদ নাযিল হয়। তাই এ রাতের মর্যাদা অপরিসীম।

শবে ক্বদরের বিশেষ দোয়া

যরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাযি.) একদা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, শবে ক্বদর যদি কখনও আমি পাই তবে কোন্ দোয়াটি আল্লাহ্র নিকট পাঠ করব? তিনি বল্লেন, এ দোয়াটি পাঠ করবেঃ “আল্লা-হুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফ্ওয়া ফা’ফু আন্নী”। অর্থঃ হে আল্লাহ্! আপনি অসীম ক্ষমাশীল, ক্ষমা আপনার পছন্দ। অতএব, আমার গুনাহ্ মাফ করুন। (তিরমিযী শরীফ, ইব্নে মাজাহ্ শরীফ)।

শবে ক্বদরের কতিপয় মাসায়েলঃ *মুফ্তিয়ে আযম আল্লামা মুফ্তী মুহাম্মদ শফী (রাহ্.) বলেন, এই পবিত্র রজনীকে শুধু জুলুস এবং ওয়ায মাহফিলে কাটিয়ে শুয়ে পড়া বড়ই অকল্যাণকর। ওয়ায মাহ্ফিল তো প্রত্যেক রাতে হতে পারে। ইবাদতের এই মূল্যবান সময়টি আর তো ফিরে আসে না। হ্যাঁ, যে সব ব্যক্তি সারা রাত জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগী করার হিম্মত করে, তারা রাতের প্রথম ভাগে কিছু ওয়ায-নসীহত শ্রবণ করে নফল ইবাদত, তাওবা-ইস্তিগফার এবং দোয়ায় লিপ্ত হতে পারে। (জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ্)।

শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কিরাম শবে ক্বদরের গোপনীয়তার এ রহস্যও ব্যক্ত করেন যে, শবে ক্বদর যদি নির্দিষ্ট রাতে অনুষ্ঠিত হত এবং তা মানুষের জানা থাকত, তবে অনেক অলস ও গাফেল হতভাগ্য ব্যক্তি এমন একটি মহান রাতের মর্যাদা না দিয়ে আল্লাহ্র গযবে পতিত হত।

* শবে ক্বদর ও শবে বরাতে অতিরিক্ত খানাপিনার আয়োজন করা কোন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। আর এই প্রচলন আমাদের সাল্ফে সালিহীনদের (পূর্বসুরীদের) মধ্যেও ছিল না। তবে আশুরার দিন অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা একটি হাদীস দ্বারা মুবাহ্ প্রমাণিত হতে পারে।

* যদি কেউ শবে ক্বদরের আলামত পেয়ে থাকে, তবে সে যেন তা পোগন রাখে এবং ইখলাসের সাথে ভাল করে দোয়া করে। (ফাত্ওয়ায়ে শামী)।

* শবে ক্বদর উপলক্ষ্যে নির্দিষ্ট কোন ইবাদত কিংবা নামাযের কোন নির্ধারিত রাক্আতের উল্লেখ নেই। যতটুকু সম্ভব সারা রাত জাগ্রত থেকে নামায, বিশেষ করে সালাতুত্ তাসবীহ্, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া-দরূদ, তাসবীহ্-তাহ্লীল ও তাওবা-ইস্তিগফারে নিমগ্ন থাকার চেষ্টা করবে।

* শবে-ক্বদর একই ভাবে শবে-বরাতে মসজিদে কিংবা মাজারে অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা এবং মাজারে-দরগাহে ঘোরাফেরা করা সম্পূর্ণ শরীয়ত পরিপন্থী। সুতরাং এই মোবারক রাতগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করতে এসব কু-প্রথা বর্জন করা এবং বেশী বেশী ইবাদত-বন্দেগী ও আল্লাহ্র দরবারে দোয়া মুনাজাত করা দরকার।

ই’তিকাফঃ ফাযায়েল ও মাসায়েল

রমযানুল মুবারক বিশেষতঃ এর শেষ দশকের উৎকৃষ্ট আমলগুলোর একটি হল ই’তিকাফ। এর অর্থ দুনিয়ার সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে শুধু আল্লাহ্র ধ্যানে তাঁর দরবারে (মসজিদে) বসে থাকা এবং সর্বদা তাঁর যিক্র-ফিক্র, তাসবীহ্-তাহ্লীলে রত থাকা। আল্লাহ্র মকবুল বান্দাগণের এ এক বিশেষ ইবাদত। এ ইবাদতের সময় হল মাহে রমযানের শেষ দশ দিন।

কুরআন নাযিল হওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ‘হেরা’ গুহায় নির্জনতা অবলম্বন করতেন। বস্তুতঃ এ ছিল তাঁর প্রথম ই’তিকাফ। এর ফলে তিনি আধ্যাত্মিকতার সেই স্তরে পৌঁছেন যেখানে তাঁর প্রতি কুরআন নাযিল হয়। আর তা ছিল রমযানের শেষ দশকের ক্বদরের রাত্রে।

রমযানের পুরো মাসটি হল মানুষের পশু বৃত্তিকে দমন করে অত্মার উন্নতি সাধনের মাস। এ মাসে হারাম কাজ ত্যাগ করার কঠোর আদেশ তো আছেই, এমনকি রোযাবস্থায় অনেকগুলো হালাল কাজও ত্যাগ করতে হয়। এরপর অত্মার চরম উন্নতি লাভের জন্য এবং আল্লাহ্র সাথে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপনের জন্য শরীয়তে রয়েছে ই’তিকাফ ব্যবস্থা। বান্দা মসজিদের কোণে ই’তিকাফ নিয়ে দুনিয়ার সকল ঝামেলা ত্যাগ করে শুধু আল্লাহ্র ধ্যানে এবং তাঁর তাস্বীহ্-তাহ্লীলে মগ্ন থাকে। আর ক্ষণে ক্ষণে নিজের সকল অপরাধের মার্জনা উদ্দেশ্যে তাওবা ও ইস্তিগফার করে। রাতের অন্ধকারে চোখের জলে নিজের বুক ভাসায়। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ গ্রহণের বিশেষ ব্যবস্থা নিতেন। এমন কি কারণ বশতঃ এক বছর ই’তিকাফ নিতে অসমর্থ হলে পরবর্তী বছর মোট বিশ দিনের ই’তিকাফ নিয়েছিলেন।

ই’তিকাফের ফযীলত

হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ নিতেন। ইন্তিকাল পর্যন্ত তাঁর এ আমল অব্যাহত ছিল। ইন্তিকালের পর তাঁর স্ত্রীগণ গুরুত্বের সাথে ই’তিকাফে বসতেন। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)।

হযরত আব্দুল্লাহ্ ইব্নে আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই’তিকাফ গ্রহণকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, এরা (ই’তিকাফ উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থানের দরুণ) গুনাহ্ হতে বেঁচে আছে এবং সৎকর্মশীল লোকদের মত তার সৎকর্মের হিসাব চলতে থাকে। (ইব্নে মাজাহ্)। অর্থাৎ মানুষ যখন ই’তিকাফের নিয়্যাতে মসজিদে বন্দী থাকে, তখন সে তাসবীহ্ ও তিলাওয়াত প্রভৃতি দ্বারা যদিও অনেক নেকী লাভ করে, কিন্তু অনেক সময় আরো বড় নেকী লাভ হতে অপারগ থাকে। যেমন, সে পীড়িত লোকের দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারে না, গরীব-মিসকীন, বিধবা ও এতিমের ফরিয়াদে সাড়া দিতে পারে না, মৃত ব্যক্তির জানাযা ও দাফন-কাফনে শামিল হতে পারে না। অথচ এই কাজগুলো বড় সাওয়াবের। তাই হাদীসে বলা হয়েছে, ই’তিকাফ গ্রহণকারীর পক্ষে সকল কাজ সম্ভব না হলেও তার আমল নামায় সাওয়াবগুলো লেখা হয়।

হযরত আয়েশা (রাযি.) হতে বর্ণিত, রমযানের শেষ দশকের রাতগুলোয় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা রাত জেগে থাকতেন এবং পরিবার-পরিজনদেরও জাগ্রত রাখতেন আর কোমর বেঁধে ইবাদত-বন্দেগী করতেন। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)।

অপর হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি মাহে রমযানের (শেষ) দশ দিনে ই’তিকাফ পালন করবে, তার এই আমল (সাওয়াবের ক্ষেত্রে) দুই হজ্ব এবং দুই উমরার সমতুল্য হবে। (তাবরানী, কানযুল উম্মাল)।

আরেকটি হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের নিয়্যাতে ই’তিকাফ নিবে, তার অতীত গুনাহ্ ক্ষমা করা হবে। (দায়লামী)।

ই’তিকাফের সংজ্ঞাঃ শরীয়তের পরিভাষায় ই’তিকাফ বলা হয়, ই’তিকাফের নিয়্যাতে পুরুষগণ মসজিদে এবং মহিলাগণ ঘরের মধ্যে নামাযের নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করা।

ই’তিকাফের আহ্কাম ও মাসায়েলঃ ই’তিকাফের জন্য তিনটি বিষয় আবশ্যকীয়। এক. পুরুষের জন্য মসজিদে অবস্থান করা। সেই মসজিদে জুম্আ হোক বা না হোক কিংবা পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করা যাক বা না যাক। আফযল ই’তিকাফ মসজিদুল হারামের, এরপর মসজিদে নববীর, এরপর মসজিদে বাইতুল মুক্বাদ্দাসের, অতঃপর যেখানে মুসল্লীর সমাগম বেশী হয়। (ফাত্ওয়ায়ে শামী, ইল্মুল ফিক্বাহ্)। দুই. ই’তিকাফের নিয়্যাতে অবস্থান করা। তিন. হায়েয-নিফাস অথবা গোসল ফরয হওয়া অবস্থা হতে পবিত্র থাকা। (ফাত্ওয়ায়ে আলমগিরিয়্যাহ্)।

ই’তিকাফ তিন প্রকার

(১) ওয়াজিব ই’তিকাফ। মান্নত করলে ই’তিকাফ ওয়াজিব হয়। সেই মান্নত শর্তযুক্ত হোক বা শর্তহীন। ওয়াজিব ই’তিকাফের জন্য রোযা রাখা শর্ত। (২) সুন্নাত ই’তিকাফ। রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ নেওয়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। অর্থাৎ মহল্লার কেউ ই’তিকাফ না নিলে সকলেই গুনাহ্গার হবে। (৩) মুস্তাহাব ই’তিকাফ। রমযানের শেষ দশক ছাড়া অন্য যে কোন সময় ই’তিকাফ নেওয়া মুস্তাহাব। তবে এ ই’তিকাফের জন্য রোযা শর্ত নয়। (ফাত্ওয়ায়ে শামী, জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ্)।

ওয়াজিব ই’তিকাফ কমপক্ষে এক দিন নিতে হয়। সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ ই’তিকাফ দশ দিনের কমে হয় না। অবশ্য ২৯ তারিখে চাঁদ দেখা গেলে ভিন্ন কথা। আর মুস্তাহাব ই’তিকাফের জন্য সময় নির্দিষ্ট নেই। এক মিনিট কালও ই’তিকাফ নেওয়া যায়। (বেহেশ্তী যেওর)।
মাহে রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ নিতে হলে ২০ তারিখের সূর্যাস্তের আগে মসজিদে পৌঁছবে এবং ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর বের হবে। (জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ্)।

ই’তিকাফ অবস্থায় দুই ধরনের কাজ নিষিদ্ধ। এক. শারীরিক প্রয়োজন যেমন পেশাব-পায়খানা ও জানাবতের গোসল এবং শরীয়তের প্রয়োজন যেমন জুম্আ আদায়ের জন্য জামে মসজিদে গমন ছাড়া ই’তিকাফের স্থান ত্যাগ করা। দুই. স্ত্রী সঙ্গম তা ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়। উপরোক্ত নিষিদ্ধ কাজ করলে ই’তিকাফ আর থাকে না। কোন কারণে ই’তিকাফ ভঙ্গ হলে তার ক্বাযা দিবে। রমযানের ই’তিকাফের ক্বাযা দিতে হলে রমযানের মাস আবশ্যক নয়, তবে রোযা রাখা আবশ্যক। মুস্তাহাব ই’তিকাফের ক্বাযা দিতে হয় না। ই’তিকাফ অবস্থায় যৌন উন্মাদনায় বির্যপাত হলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হয় না। (হিদায়াহ্, বেহেশ্তী যেওর)।

শারীরিক বা শরীয়তের প্রয়োজন পূরণ হওয়া মাত্র মসজিদে প্রবেশ করবে। নিকটবর্তী স্থানে প্রয়োজন সেরে নিবে। খাদ্য আনার জন্য কেউ না থাকলে নিজে গিয়ে ঘর থেকে খাদ্য নিয়ে আসতে পারে। তবে অধিক সময় বিলম্ব করবে না। জুম্আর গোসল বা শরীর শীতল করার মানসে গোসল করার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া ই’তিকাফকারীর জন্য জায়েয নেই। বের হলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হবে। হ্যাঁ, যদি গোসল না করলে শারীরিক অবস্থা একেবারে খারাপ হয়ে পড়ে, তখন পায়খানা-পেশাবের জরুরত সেরে আসার পথে বিলম্ব না করে শুধু শরীর শীতল করার মানসে গোসল করা যেতে পারে। (আহ্সানুল ফাত্ওয়া)। তবে ফরয গোসল ও ওযূ করার জন্য বের হতে পারে। মসজিদের ভিতর ওযূ-গোসলের ব্যবস্থা থাকলে বের হবে না। তবে এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন ওযূ ও গোসলের পানি মসজিদের ভিতরে না পড়ে। আযান দেওয়ার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয আছে। (ফাত্ওয়ায়ে শামী)।

উপরোক্ত শরীয়ত ও শারীরিক প্রয়োজন ছাড়া ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অল্প সময়ের জন্যও মসজিদ থেকে বের হলে ইমাম আবু হানিফা (রাহ্.)এর মতে ই’তিকাফ ভঙ্গ হবে। (হিদায়াহ্, র্দুরে মুখতার)। কোন মুমুর্ষ রোগীর সাথে সাক্ষাত বা পানিতে ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানোর জন্য কিংবা আগুন নির্বাপণের জন্য অথবা অন্য কোন প্রয়োজনে বের হলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হবে। তবে শরীয়ত সম্মত প্রয়োজন পূরণে বের হলে চলার পথে রোগীর সাথে দেখা বা জানাযায় শামিল হওয়া জায়েয আছে। ই’তিকাফ ভঙ্গ হবে না। (বেহেশ্তী যেওর)। মসজিদে হুক্কা বা বিড়ি সিগারেট পান করা জায়েয নেই এবং ই’তিকাফ গ্রহণকারী এই উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বেরও হবে না। ই’তিকাফকারীর জন্য উচিত যে, তারা যেন ই’তিকাফ কালে হলেও এ অভ্যাস পরিত্যাগ করে। (কিফায়াতুল মুফ্তী)।

ই’তিকাফকালে পরনিন্দা, মিথ্যা, অপবাদ এবং অনর্থক কথাবার্তা ও গল্পগুজব হতে বিরত থাকবে। কারণ, ই’তিকাফের সময়টি বড় মূল্যবান। ই’তিকাফ গ্রহণকারী আল্লাহ্র ঘরের মেহমান। তারা ফেরেশ্তাগণের মতই। ফেরেশ্তাগণ যেমন সর্বদা আল্লাহ্র তাসবীহ্-তাহ্লীলে রত থাকে, তারাও সেভাবে সময় অতিবাহিত করে। কুরআন তিলাওয়াত, দরূদ, তাসবীহ্-তাহ্লীল ও অন্যান্য যিক্রে ব্যস্ত থাকবে অথবা ওয়ায-নসীহত ও দ্বীনী ইল্ম চর্চায় রত থাকবে। ই’তিকাফের জন্য কোন বিশেষ ইবাদত নির্দিষ্ট নেই।

জরুরী হিদায়াতঃ ই’তিকাফ কালে মসজিদের আদব ও হুরমতের লেহায রাখতে হবে। মসজিদের আদব সংক্রান্ত মাসায়েল অনেক। এ বিষয়ের কিতাব দেখে কিংবা অভিজ্ঞ আলেমের নিকট হতে জরুরী আদব সম্পর্কে আগে জেনে নেওয়া উচিত। প্রধান আদব হল, মসজিদের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি দৃষ্টি রাখা। যেন খাওয়া, পান করা ইত্যাদিতে মসজিদ ময়লা না হয়। কারণ, মসজিদ আল্লাহ্র ঘর, বেহেশ্তের বাগান এবং আখেরাতের বাজার। যে কোন অপরিচ্ছন্নতায় মসজিদে ফেরেশ্তা-গণের দারুণ কষ্ট হয়। দ্বিতীয় আদব হল, বাজে গল্পগুজব ও অনর্থক কথাবার্তা হতে দূরে থাকা।

সাধারণতঃ অনেকে এ ব্যাপারে অসতর্ক থাকে এবং গোল বৈঠকে বাজে গল্পগুজবে সময় নষ্ট করে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, এমন এক যুগ আসবে যখন লোকেরা মসজিদে দুনিয়াবী কথাবার্তায় লিপ্ত হবে। তোমাদের কর্তব্য তাদের পাশে না বসা। এ শ্রেণীর লোকের সাথে আল্লাহ্র কোন সম্পর্ক নেই। (মিশ্কাত শরীফ, শুআবুল ঈমান)। প্রসিদ্ধ ফাত্হুল ক্বাদীর গ্রন্থে লেখা আছে, মসজিদে দুনিয়াবী মুবাহ্ (অনর্থক কথা) নেক আমলকে এরূপ নষ্ট করে যেরূপ আগুন কাঠকে ভষ্ম করে। সুতরাং মসজিদে তদুপরি ই’তিকাফে বসে বাজে কথাবার্তা ত্যাগ করতঃ যতটুকু সম্ভব ইবাদত-বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকা আবশ্যক।

লেখকঃ প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ, গ্রন্থ লেখক, জনপ্রিয় ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও মুরুব্বী এবং সহযোগী পরিচালক ও মুহাদ্দিস- জামিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

কোন মন্তব্য নেই:

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট গুলো দেখুন, আর মন দিয়ে পড়ুন৷ আমার জানা মতে ক্ষতি হবেনা আপনার৷ ইশা-আল্ল-হ৷

বাংলাদেশে হাবশী শাসক

আমাদের এই দেশ একসময় সুদূর আফ্রিকা থেকে আগত হাবশীদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে হাবশী কারা? 'হাবশা' বলতে মূলত ইথ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ দেখুন